সুমন আহম্মেদঃ
অবশেষে সরাইলের ধর্মতীর্থ এলাকার ঐতিহাসিক বধ্যভূমিতে “ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার স্থান, এই স্থানের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করা হইল”। এধরনের লেখা সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড টানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। গত সোমবার বিকেলে সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই আঞ্চলিক সড়কের পাশে দখলকৃত ওই জায়গায় জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গণহত্যার স্থানের স্বীকৃতির সাইনবোর্ডটি স্থাপন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম মোসা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা,
মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ সহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। এ সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে দেওয়া অনাপত্তিপত্রের প্রতিবেদনটিও তিনি বাতিল ঘোষণা করেন। ফলে দখলমুক্ত হয়েছে বধ্যভূমি ও সওজের জায়গা। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় লোকজন জানান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ছাড়াও স্থানটি নৌঘাট হওয়ায় নিয়মিতই অভিযান চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করত।
এদের মধ্যে চুন্টার সংখ্যালঘু সমাপ্রদায়ের এক পরিবারের ২২ জন হত্যার ঘটনাটি ছিল চাঞ্চল্যকর। এসব কারনে এ জায়গাটি বধ্যভূমি হিসাবে স্বীকৃত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে’ও এর দালিলিক প্রমাণসহ উল্লেখ করেছেন অনেক লেখক। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘদিন ধরে ওই বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় একটা কিছু করার চেষ্টা করে আসছিলেন। সওজের খাল সংলগ্ন পশ্চিম পাশে কালিকচ্ছ ইউনিয়নের ধর্মতীর্থ মৌজার ৪৭৩৬ দাগের ২২ শতাংশ ভূমির মালিক ছিলেন চাকসার গ্রামের আবদুস সাত্তার ও তার ভাতিজা আবদুল আহাদ ছিলেন ৮৮৩১ দাগের ১২ শতক জায়গার মালিক। জায়গাটির ৪০-৫০ গজের মধ্যে রয়েছে একাধিক বসতবাড়ি।
১০ বছর আগে ওই দুইদাগের ৩৪ শতাংশ জায়গা ক্রয় করেন ফরহাদ রহমান। পরে তিনি পানি নিষ্কাশনের খাল ধর্মতীর্থ নৌঘাট, ধর্মতীর্থ বধ্যভূমি ও সওজের জায়গা পর্যন্ত মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলেন। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধার সহায়তায় ওই বধ্যভূমিতে ১২ ফুট উচ্চতা ও ৪ ফুট প্রস্থের লোহার তৈরী একটি ফলক স্থাপন করেন। ফলকে ৪৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকাযুক্ত সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এক বছর পরই সাইনবোর্ডটি চুরি হয়ে যায়।
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ নভেম্বর জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান বধ্যভূমিটি সরজমিনে পরিদর্শনও করেছেন। গত ১৮ জুন ওই জায়গায় ‘এম আবদুল্লাহ ফরহাদ ফিলিং ষ্টেশন’ নামে একটি পেট্রোল পাম্প করার অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে অনাপত্তির আবেদন করেছেন ফরহাদ রহমানের ছেলে আবদুল্লাহ ফরহাদ। ৪ জুলাই জেলা প্রশাসক ২০৪ নং স্বারকে তদন্ত করে অনাপত্তি প্রতিবেদন চেয়ে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করেন। ইউএনও দেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) ফারজানা প্রিয়াংকাকে। সহকারি কমিশনারের মৌখিক নির্দেশে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরী করেন সার্ভেয়ার ও কাননগো মো. ইব্রাহিম খান। সহকারি কমিশনার প্রতিবেদনটি ৯ জুলাই প্রেরণ করেন ইউএনও’র কাছে। ইউএনও ওই প্রতিবেদনটি গত ১০ জুলাই প্রেরণ করেছেন জেলা প্রশাসকের দফতরে। আর ১০ জুলাই রাতেই বধ্যভূমি থেকে উধাও হয়ে যায় ৪৬ জন শহীদের নাম সম্বলিত ফলকটি। তবে প্রতিবেদনের সাথে বাস্তবতার কোন মিল না থাকার বিষয়টি চাওর হতে থাকে গোটা সরাইলে। এ ঘটনায় ২০ জুলাই জাতীয় একটি দৈনিকে “নেপথ্যে সওজের জায়গা দখল, সরাইলে বধ্যভূমি থেকে ৪৬ শহীদের নাম ফলক উধাও” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নজরে আসে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের। ঘটনার ১ মাস ২৩ দিন পর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ‘ধর্মতীর্থ গণহত্যা’ নামক স্থানটিতে ছুটে যান সরাইলের ইউএনও এএসএম মোসা। এর আগে তিনি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকলকে উপস্থিত থাকার আহবান জানান। সোমবার বিকাল ৫টার দিকে যান ওই বধ্যভূমিতে।
উপস্থিত ছিলেন সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মো. ইসমত আলী, ডেপুটি কমান্ডার মো. আনোয়ার হোসেন, কালিকচ্ছ ইউপি কমান্ডার রমেশ চন্দ্র দেব সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক এমপি মৃধা বধ্যভূমির স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি বিজড়িত একটি ফেনা লাগানোর জন্য উপজেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এএসএম মোসা বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও গণ্যমান্য লোকদের সহায়তায় মূল বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করেছি। পরে সেখানে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছি।
###