আমার গ্রাম, আমার প্রাণ -মোঃ বাহারুল ইসলাম মোল্লা

botvনিউজ:

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন যে একটি এলাকার মানুষের জীবনধারাকে বদলে দিতে পারে তার প্রকৃত উদাহরণ আমাদের গ্রাম পানিশ্বর। জেলার সরাইল উপজেলার মেঘনা-নদীর তীর ঘেষা গ্রাম এটি। আমার গ্রামটি আমার প্রাণ। আমার গ্রামকে আমি খুবই ভালোবাসি।

আমাদের গ্রামের আগের নৈসর্গিক পরিবেশ এখন আর নেই। মেঘনা নদীর ক্রমাগত ভাঙ্গনে প্রতি বছরই বদলে যাচ্ছে পানিশ্বরের মানচিত্র। মেঘনার ভাঙ্গন এখনো অব্যাহত রয়েছে। ক্রমাগত ভাঙ্গনে ইতিমধ্যেই গ্রামের অনেকেই বসত-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ইতিমধ্যেই নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে পানিশ্বর বাজার সংলগ্ন পালপাড়া। আমি অবিলম্বে মেঘনার ভাঙ্গন থেকে পানিশ্বরকে রক্ষার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি পুরাতন ও প্রসিদ্ধ বাজার হচ্ছে পানিশ্বর বাজার। ভাটি এলাকার এটি একটি বৃহৎ বাজার এটি। এক সময় পানিশ্বর বাজারে দেখা যেতো ধান-চালের বড় বড় আড়ৎ। তবে আগের অবস্থা এখন আর নেই। এখন পানিশ্বর বাজারে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি মার্কেট ও চাতাল কল।

ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র-বিন্দু হলেও এক সময়ে পানিশ্বরের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো খুবই নাজুক। বর্ষাকালে নৌকা এবং লঞ্চই ছিল ওই এলাকার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র বাহন। গ্রীষ্মকালে পায়ে হাঁটা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা গ্রামের মানুষের। গ্রামের ভেতরের রাস্তা-ঘাটগুলোও ছিলো কঙ্কালসার অবস্থা। রাস্তা বলতে ছিল মাটির গোপাট।
অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে এক সময় শিক্ষা-দীক্ষাসহ সব দিকদিয়েই পিছিয়ে ছিলো আমাদের এলাকার মানুষ। শিক্ষার হার ছিলো খুবই নগন্য।

গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা ছিলো ব্যবসা। বিশেষ করে ধান-চালের ব্যবসা। প্রতিদিন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এলাকার মানুষ নৌকা ও লঞ্চে করে যাতায়ত করতো আশুগঞ্জ ও ভৈরবে। বর্ষাকাল ছাড়া সরাইল উপজেলা সদরে যেতে হতো প্রায় ৫ কিলোমিটার পায়ে হেটে। বর্ষাকালে তিন মাস জাফর খালে নৌকা চলতো। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে এলাকার মানুষের দুদর্শার শেষ ছিলোনা।

ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েও প্রতিদিন পানিশ্বর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার হেটে সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করতেন আমার আব্বা মোঃ নজরুল ইসলাম ও আমার ছোট চাচা মোঃ সাইকুল ইসলাম। পানিশ্বর থেকে জমির আইল দিয়েই হেটে স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন আমার আব্বা ও চাচা। কষ্ট করে লেখাপড়া করায় আমার আব্বা ও আমার ছোট চাচা হতে পেরেছিলেন সরকারি চাকুরীজীবি।

ছোট বেলা স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আমরা পরিবার-পরিজনসহ গ্রামে বেড়াতে যেতাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে করে আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন। তার পর রিকসা নিয়ে আশুগঞ্জ লঞ্চঘাট। সেখান থেকে লঞ্চে পানিশ্বর বাজার। কখনো কখনো লঞ্চের জন্য দুই আড়াই-ঘন্টা বসে থাকতে হতো লঞ্চ ঘাটে। এক সময় আশুগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে পানিশ্বর বাজার পর্যন্ত ইঞ্জিনের নৌকা চলাচল শুরু হয়। বর্ষাকালে বিকল্প পথে সরাইল থেকে গয়না নৌকা দিয়ে জাফর খাল দিয়ে পরিবার-পরিজনসহ যেতাম গ্রামের বাড়িতে।

যাক সে কথা, গ্রামের সেই অবস্থা এখন আর নেই। বদলে গেছে আমাদের গ্রাম। বদলে গেছে গ্রামের মানুষের জীবনধারা। এক সময় গ্রামে ছনের ঘর থাকলেও গ্রামে এখন আর কোন বাড়িতে ছনের ঘর নেই। গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে নির্মিত হয়েছে দোতালা, তিনতলা বিল্ডিং। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এখন স্কুল মুখী। শহর থেকে রাতের বেলাও অল্প সময়ে গ্রামে যাওয়া যায়।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিশাল বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু তনয়া, জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দ্রুত বদলাতে থাকে পানিশ্বরের চিত্র। গ্রামের কঙ্কালসার রাস্তাগুলো উচু ও প্রশস্থ করে সংস্কার করা হয়। নতুন করে নির্মান করা হয় বেশ কয়েকটি রাস্তা ও কালভার্ট। গ্রামের প্রায় প্রতিটি রাস্তাই এখন মানুষের চলাচলের উপযোগী। জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর আমাদের গ্রামের উন্নয়নের চাকা ঘুরতে থাকে জোরেসোরে। গ্রামের প্রধান প্রধান রাস্তাগুলো কার্পের্টিং করে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করা হয়। পানিশ্বরের দুই বাজারের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া জাফর খালের উপর গ্রামবাসী তাদের নিজস্ব অর্থায়নে একটি দৃষ্টিনন্দন বেইলী ব্রীজ নির্মান করে। বেইলী ব্রীজটি নির্মানের ফলে এক বাজার থেকে অন্য বাজারে যেতে লোবজনকে আর গুদারার জন্য অপেক্ষা করতে হয়না।

বর্তমানে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আশুগঞ্জ উপজেলার খড়িয়ালা ও বগুইর থেকে শতশত অটোরিকসা পানিশ্বর বাজার পর্যন্ত চলাচল করে। গ্রামের লোকজন এখন খুব সহজেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে অটোরিকসা দিয়ে যাতায়ত করতে পারে। এলাকার রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত বাড়তে থাকে এলাকায় শিক্ষার হার। আমাদের গ্রামের মেয়েরা এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা সদর, আশুগঞ্জ, ভৈরবের বিভিন্ন কলেজে গিয়ে লেখাপড়া করে। গত ১০ বছরে গ্রামে বেড়েছে শিক্ষিতের হার।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এলাকার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লাগে উন্নয়নের ছোয়া। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সৃষ্টি হয় শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ। পানিশ্বর বাজারে প্রতিষ্ঠিত পানিশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়টি এখন দৃষ্টি নন্দন। চারতলা ভবন বিশিষ্ট এই মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি সব সময় শিক্ষার্থীদের পদচারনায় মুখরিত থাকে। পানিশ্বর মাদিনিয়া গাউছিয়া দাখিল মাদরাসাটিও এখন বেশ উন্নত। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারনে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে এলাকায় সামসুল আলম উচ্চ বিদ্যালয় নামে আরেকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য আমাদের এলাকার শিক্ষার্থীদেরকে আর সরাইল-আশুগঞ্জে যেতে হয়না। পানিশ্বরেই আছে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা। এলাকায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষার উন্নয়নে এলাকায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার দাবি এখন সবারই মুখে মুখে।

রাস্তা-ঘাট সংস্কার করে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা যেকোন সময় যেতে পারছে শহরে। এলাকায় রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হওয়ার পর আমিও সুযোগ পেলে এখন গ্রামে যাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে অটোরিকসা নিয়ে পানিশ্বর বাজার। রাস্তায় কোন ভোগান্তি নেই।

এদিকে সরাইল থেকেও পানিশ্বর বাজার পর্যন্ত একটি রাস্তার নির্মান কাজ চলছে। সরাইল-পানিশ্বর রাস্তাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রতিশ্রুত প্রকল্প। এই রাস্তাটির নির্মান কাজ শেষ হলে পানিশ্বর গ্রামটি হয়ে যাবে অনেকটাই শহরের মতো। আমরা রইলাম সেদিনের অপেক্ষায়। এছাড়াও সরাইল থেকে জাফর খালের পাড় দিয়ে এখন পানিশ্বরে যাতায়ত করা যায়।

একটি অবহেলিত এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড করে ওই এলাকাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি পানিশ্বরকে মেঘনার ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করতে মেঘনা নদীর তীরে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মান, পানিশ্বর লঞ্চঘাটে একটি জেটি নির্মান এবং পানিশ্বরের শিশুদের চিত্র বিনোদনের জন্য একটি খেলার মাঠ নির্মান করে দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই।
লেখকঃ-সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরো খবর

ফেসবুকে আমরা..