স্টাফ রিপোর্টার,ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার চর-চারতলা গ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ হানিফ মুন্সির ছোট ভাই মোঃ জামাল মুন্সী নিহত হওয়ার পর গ্রামজুড়ে চলছে তান্ডব। পুলিশী গ্রেপ্তার এড়াতে ও প্রাণের ভয়ে অভিযুক্তরা বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় ওইসব ফাঁকা বাড়ি-ঘর প্রতিদিন ভাংচুর ও লুটতরাজ করা হচ্ছে।
গত ২২ জানুয়ারি চর-চারতলা গ্রামের লতিফ বাড়ি ও খন্দকার বাড়ির লোকজনের হামলায় নিহত হন জামাল মুন্সী-(৫৫)। নিহত জামাল মুন্সী আশুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আশুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক হানিফ মুন্সীর ছোট ভাই।
অভিযোগকারীরা জানান, জামাল মুন্সী নিহত হওয়ার পর হানিফ মুন্সীর পরিবার ও গোষ্ঠীর লোকজন প্রতিপক্ষ লতিফ বাড়ি ও খন্দকার বাড়ির ফাঁকা ঘর-বাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। শুধু তাই নয়, আশুগঞ্জ বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা প্রতিপক্ষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভাড়াটিয়াদের হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। তাঁদের ভয়ে এলাকার মানুষ মুখে কলুপ এটেছেন।
এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো আশুগঞ্জ থানায় মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পৃথক ৬টি মামলা দায়ের করেছেন। প্রতিটি মামলাতেই হানিফ মুন্সিকে প্রধান আসামী করা হয়।
বর্তমানে চর-চারতলা গ্রামে এখন বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। যে কোন সময় গ্রামে আরো খুনসহ বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে বলে আশংকা করছেন গ্রামের নিরীহ লোকজন। তবে হানিফ মুন্সির দাবি, লুটপাটের ঘটনা প্রতিপক্ষের নিজেদের সাজানো।
এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ জানুয়ারি রাতে চর-চারতলা গ্রামের লতিফবাড়ি ও খন্দকার বাড়ির লোকজনের হামলায় নিজ বাড়িতে খুন হন জামাল মুন্সী।
হত্যাকান্ডের পরদিন নিহতের অপর ভাই মোঃ জাহাঙ্গীর মুন্সী বাদি হয়ে চর-চারতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউদ্দিন খন্দকারসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখপূর্বক অজ্ঞাতনামা আরো ২০/২৫ জনকে আসামী করে আশুগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এদিকে হত্যাকান্ডের পর পরই গ্রেপ্তার এড়াতে ও প্রাণের ভয়ে লতিফ বাড়ি ও খন্দকার বাড়িসহ কয়েকটি বাড়ির অন্তত ৫০-৬০টি পরিবারের হাজার খানেক নারী-পুরুষ গ্রাম থেকে চলে যায়।
অভিযোগকারীরা জানান, জামাল মুন্সী খুন হওয়ার পর থেকে হানিফ মুন্সীর পরিবারের লোকজন প্রতিদিনই প্রতিপক্ষের ফাঁকা বাড়িতে ভাংচুর ও মালামাল লুটপাট করছে। বাড়ি-ঘরে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন চরচারতলা গ্রামের লতিফ বাড়ির মোঃ আবদুল লতিফ মিয়ার স্ত্রী মোছাঃ রওশন আরা বেগম।
মামলার আরজিতে তিনি বলেন, জামাল মুন্সির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে হানিফ মুন্সীর অপর ভাই জাহাঙ্গীর মুন্সী তার স্বামী (বাদির), স্বামীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ আশপাশের বাড়িঘরের লোকজনকে আসামি করে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করলে পুলিশের ভয়ে পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে এসব বাড়ি ঘর। এ সুযোগে হানিফ মুন্সির নির্দেশে তার পরিবারের সদস্যরা বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে গত ৩১ জানুয়ারি সন্ধ্যে সাড়ে ৭ টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত তার বাড়িতে লুটপাটের মহোৎসব চালায়। এ সময় হামলাকারীরা তার বাড়ির প্রধান গেইট ভেঙ্গে বাড়িতে প্রবেশ করে বাড়ির দরজা জানালা আসবাবপত্র বিছানাপত্র, নগদ টাকা স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান মালামাল পিকআপ ভ্যানে করে প্রকাশ্যে লুটে নিয়ে যায়। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩৫ লাখ টাকা।
একই দিনে ভাংচুরের ঘটনায় আদালতে অপর আরেকটি মামলা দায়ের করেন চরচারতলা গ্রামের আতিক বাড়ির আবু শহীদ মিয়ার স্ত্রী মোছাঃ মনোয়ারা বেগম।
মামলার আরজিতে তিনি বলেন, জামাল মুন্সী হত্যাকান্ডের পর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সির নির্দেশে তার পরিবারের সদস্যরা গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা থেকে রাত ৩ টা পর্যন্ত ওই গ্রামের আতিক বাড়ির আবু শহীদ মিয়ার বাড়িতেও হামলা চালিয়ে লুটপাটে তান্ডব চালিয়ে গরুর খামার থেকে ৬টি ফ্রিজিয়ান গাভী (বাছুরসহ), স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ প্রায় ৬৫ লাখ টাকার মূল্যবান জিনিসপত্র শত শত মানুষের সামনেই পিকআপে ভরে লুটে নিয়ে যায়। কিন্তু তাদের ভয়ে কেউ বাঁধা দেয়ার সাহস করেনি।
একই কায়দায় গত ৫ ও ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে চর চারতলা গ্রামের নয়াহাটির খন্দকার বাড়িতে হামলা চালিয়ে প্রবাসী মোঃ সালাহ উদ্দিন খন্দকার এবং মোঃ জিয়াউদ্দিনের বাড়িতে তান্ডব চালিয়ে বাড়ির গেইট, দরজা জানালা, আসবাবপত্র, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ যথাক্রমে ২৩ লাখ এবং ২৭ লাখ টাকার মালামাল লুটে নেয় হামলাকারীরা।
এ সব লুটপাটের ঘটনায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ওই দুই বাড়ির গৃহকর্ত্রী মোছাঃ নিপা আক্তার এবং ফরিদা বেগম বাদী হয়ে হানিফ মুন্সিসহ অপরাপর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা দায়ের করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, শুধু বাড়ি-ঘরে হামলা-ভাংচুরই নয়। প্রতিপক্ষের বিভিন্ন বাড়ির নলকূপের পাম্প খুলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তাদের জমির ফসলও জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গেছে হানিফ মুন্সীর লোকজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন বয়সের একাধিক ব্যক্তি জানান, গ্রামে এখন সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। কেউ ভয়ে কোন কথা বলছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে গ্রামে আবার খুন-খারাপিসহ বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে।
এ ব্যাপারে চরচারতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও হত্যা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত মোঃ জিয়াউদ্দিন খন্দকার বলেন, জামাল মুন্সী খুনের পর হানিফ মুন্সির নির্দেশে তার গোষ্ঠীর লোকজন গ্রামের লতিফবাড়ি ও খন্দকার বাড়ির লোকজনের বাড়িতে হামলা-ভাংচুর ও লুটতরাজ শুরু করেছে। হামলা-ভাংচুর এখনো অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, শুধু বাড়ি-ঘরে হামলা-ভাংচুরই নয়, আশুগঞ্জ বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভাড়াটিয়াদের হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। আমরা উচ্চ আদালত থেকে অন্তবর্তী জামিন নিয়েও তাদের ভয়ে গ্রামে যেতে পারিনি। তিনি বলেন, হামলা-ভাংচুরের ঘটনায় আশুগঞ্জ থানায় মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে আমাদের (ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার) পক্ষ থেকে আদালতে পৃথক ৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলো সিআইডি, ডিবি ও পিবিআই তদন্ত করছেন।
এ ব্যাপারে নিহত জামাল মুন্সীর বড় ভাই ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ হানিফ মুন্সীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মামলার আসামী জিয়াউদ্দিন খন্দকার, সেলিম পারভেজসহ অন্যান্যরা পুলিশ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তাদের বাড়ির মালামাল ট্রাকে করে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেছে। এ সংক্রান্ত ভিডিও আমার কাছে আছে। তিনি বলেন, হত্যা মামলাকে অন্যদিকে প্রভাবিত করার জন্য আসামীপক্ষ আমি ও আমার গোষ্ঠীর লোকজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছে।
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ জাবেদ মাহমুদ বলেন, জামাল মুন্সী হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ৬জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৫জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তিনি বলেন, মামলার আসামীপক্ষ বাড়ি-ঘরে হামলা-ভাংচুরের ঘটনায় থানায় মামলা করতে আসে নাই। শুনেছি তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আদালতে কয়েকটা মামলা করেছে। তারা থানায় আসলে আমরা অবশ্যই মামলা নিতাম। তিনি বলেন, বর্তমানে এলাকার পরিবেশ ভালো আছে।